ঢালাও আসামি করায় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে মামলা

ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে শেখ হাসিনার সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি দলীয় কর্মীদের দিয়ে নির্বিচার গুলি করে মানুষ হত্যা করেছে। কিন্তু এসব ঘটনায় একের পর এক মামলায় ঢালাওভাবে আসামি করা হচ্ছে। এর ফলে মামলা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এ ধরনের মামলায় ভুক্তভোগীদের অর্থাৎ নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলে মনে করছেন আইনবিশেষজ্ঞরা।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ঘটনাই ঘটেনি, তারপরও কাল্পনিক কাহিনি সাজিয়ে অসংখ্য মামলা দিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা–কর্মীসহ সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হতো। এসব মামলা গায়েবি মামলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। গায়েবি মামলার বাদীরা ছিল হয় পুলিশ, নয়তো আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মী। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রথম আলোর হিসাব অনুযায়ী, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের গুলি, সংঘর্ষ ও বিভিন্ন ধরনের সহিংসতায় গত ১৬ জুলাই থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে কমপক্ষে ৭৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে শিক্ষার্থী, নারী, শিশু, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ ঘটনাস্থলে আবার কেউ চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরে হাসপাতালে মারা গেছেন।
নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের করা কোনো কোনো মামলায় ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে আসামি করা হয়েছে। স্থানীয় বিরোধের জেরেও কোনো কোনো ব্যক্তিকে অন্য অনেকের সঙ্গে মামলায় আসামি করার অভিযোগ আছে।

আইনবিশেষজ্ঞরা বলছেন, হত্যা মামলা করার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হয়। কিন্তু যে মামলাগুলো হচ্ছে, তাতে বেশির ভাগ আসামির ক্ষেত্রে ‘হুকুমদাতা-নির্দেশদাতা’ উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধরনের মামলা আদালতে টিকবে, এমন সম্ভাবনা কম। তাই ভুক্তভোগীরা যাতে ন্যায়বিচার পান, সে জন্য থানায় বা আদালতে মামলা নেওয়ার ক্ষেত্রে যাচাই–বাছাইয়ের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে দিকনির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন।

ছয়টি মামলার বাদীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের পাঁচজনই বলেছেন, পরিচিতজনদের পরামর্শে আসামিদের নাম মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। আরেকজন বাদী তাঁর করা মামলায় আসামিদের দীর্ঘ তালিকার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

কোনো কোনো মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৩৯৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো কোনো মামলায় নাম উল্লেখের পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ জনকে। মামলার আসামিরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য। কোনো কোনো মামলায় দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের আসামি করা হয়েছে। কোনো কোনো মামলায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের নেতারাও আসামি। এ ছাড়া প্রায় সব মামলায় স্বাভাবিক কারণেই বিগত সরকারের সময় দায়িত্বে থাকা পুলিশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়েছে। কিছু মামলায় সাংবাদিকসহ আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছেন।
এখন ঢালাও মামলা দেওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে তা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। গত ২৮ আগস্ট গুলশানে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘যেকোনো মানুষের বিরুদ্ধে শত্রুতা থাকলেই মামলা দেওয়া হচ্ছে। মামলাগুলো নেওয়ার আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো যাতে যাচাই করে নেয় যে কোনটি সম্ভব, কোনটি সম্ভব নয়। প্রাথমিক যে তদন্ত, সেটা করা দরকার, তা না হলে একটু ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকলে তার নাম দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’

ঢালাও মামলার উদাহরণ দিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, দেখা যাচ্ছে, সেই খাগড়াছড়িতে কোনো ঘটনা ঘটেছে, সেটার মামলা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে গোটা দেশের (আওয়ামী লীগের) নেতাদের কেন্দ্র করে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।

গণ–অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। এরপর দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান তিনি। দেশ ছাড়ার পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কমপক্ষে ১০৫টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা কমপক্ষে ৯৭টি। একই সঙ্গে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় আটটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এতে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব অভিযোগের মধ্যে সাতটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে। অপরটি হচ্ছে ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচি ঘিরে গণহত্যার অভিযোগ।