দেশজুড়ে তীব্র গরমের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেছে। কিন্তু সে অনুযায়ী উৎপাদন না হওয়ায় বেড়ে গেছে লোডশেডিং। প্রতিদিন ৪০০ থেকে প্রায় ৮৫০ মেগাওয়াটের কাছাকাছি লোডশেডিং করতে হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগকে। মধ্যরাতে লোডশেডিং হচ্ছে বেশি। ওই সময় গড়ে ৭০০ মেগাওয়াটের কাছাকাছি লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল দিনে বিদ্যুতের গড় চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। আর রাতে ছিল সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াটের মতো।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ঘণ্টাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ও লোডশেডিংয়ের হিসাব বলছে, গতকাল দুপুর ১২টায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৩৭৫ মেগাওয়াট। উৎপাদন হয় ১৩ হাজার ৬৬০ মেগাওয়াট। ওই সময় লোডশেডিং দেখানো হয় ৬৮৩ মেগাওয়াট। গতকাল রাত ৪টায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ৮৫০ মেগাওয়াট। উৎপাদন হয় ১৩ হাজার ২২৫ মেগাওয়াট। ওই সময় লোডশেডিং দেখানো হয় ৫০১ মেগাওয়াট। এর আগে রাত ১টায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ১০০ মেগাওয়াট। উৎপাদন ছিল ১৪ হাজার ২০৭ মেগাওয়াট। লোডশেডিং দেখানো হয় ৮৫৩ মেগাওয়াট।
১ জুন বিদ্যুৎ চাহিদা ও উৎপাদনে ঘাটতি থাকায় সারা দেশে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে লোডশেডিং করতে হয়েছে। এদিন রাত ৮টায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ৮৫০ মেগাওয়াট। উৎপাদন ছিল ১৫ হাজার ২০৮ মেগাওয়াট। এর আগে বিকাল ৪টায় বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনে ঘাটতি ছিল ৬৯১ মেগাওয়াট।
গত সপ্তাহে ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে দেশে ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় প্রায় পৌনে তিন কোটি গ্রাহক বিদ্যুৎহীন ছিলেন, যা মোট গ্রাহকের প্রায় ৫৮ শতাংশ। ঘূর্ণিঝড়ের পর সংযোগ স্বাভাবিক হতে থাকলে চাহিদাও বাড়তে থাকে। এর মধ্যে গতকাল দেশের ১৬ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তাপপ্রবাহের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা আরো বেড়ে যায়।
চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় বরাবরই সমন্বয় বা লোডশেডিং করে চলতে হয় বিতরণ কোম্পানিগুলোকে। সাড়ে তিন-চার হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিংও করতে হয়েছে। তবে বর্তমানে বিদ্যুতে যে পরিমাণ ঘাটতি হচ্ছে, সেটি মূলত গ্যাস সংকট ও বিতরণ ব্যবস্থা অনেক পুরনো হওয়ার কারণে। তবে অন্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করবে বিপিডিবি।
বিপিডিবির সদস্য (বিতরণ) রেজাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনে কিছুটা ঘাটতি হচ্ছে এটা সত্য। সেটি গ্যাসের কারণে। গ্যাসভিত্তিক দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন আগে থেকেই ঘাটতি রয়েছে পিডিবির। আগে যেখানে গ্যাস থেকে সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যেত, সেখানে এখন পাঁচ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন হচ্ছে। এর বাইরে ময়মনসিংহ ও রংপুরের কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহে কিছুটা সমস্যা রয়েছে। তবে সেটি খুব বেশি নয়। সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে।’
দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনে যে পরিমাণ ঘাটতি দেখানো হচ্ছে, তা বিতরণ কোম্পানিগুলোর হিসাবের চেয়ে অনেক কম। দেশের সবচেয়ে বেশি গ্রাহক পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি)। সংস্থাটির একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আরইবিতে বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে এক-দেড় হাজার মেগাওয়াট।
পল্লী বিদ্যুতের বাইরে রাজধানীর দুই বিতরণ কোম্পানি হলো ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পান লিমিটেড (ডেসকো)। এ দুই বিতরণ কোম্পানির গ্রাহকরাও লোডশেডিংয়ের কথা জানিয়েছেন।
ডেসকো মিরপুর-২ এলাকার বাসিন্দা মো. মনিরুল ইসলাম জানান, লোডশেডিং বড় আকারে না হলেও মধ্যরাত ও ভোরে হচ্ছে। তীব্র গরমে বিদ্যুৎ বিভ্রাট পরিস্থিতি আরো অসহনীয় করে তুলছে।
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে গড় চাহিদা সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু গ্যাসের অভাবে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্ধেক সক্ষমতা বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্য ও ডলার সংকটের কারণে সেখান থেকেও পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। সময়মতো বিল পরিশোধ না করায় কমে গেছে আমদানীকৃত বিদ্যুতের পরিমাণও।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ১২ হাজার ২১৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে উৎপাদন হচ্ছে সর্বোচ্চ ছয় হাজার মেগাওয়াট। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা ৬ হাজার ৬০৪ মেগাওয়াট। সেখান থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট। তরল জ্বালানির সক্ষমতা ছয় হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতা থাকলেও গড়ে সেখানে থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আসছে গড়ে ৫০০ মেগাওয়াট। এক হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি ভারত থেকে আমদানি হচ্ছে।