বাংলাদেশ বাণিজ্যসুবিধা পেলেও এখনো চীনের সাথে বাণিজ্যঘাটতি অনেক বেশি। চীন থেকে সাম্প্রতিক সময়ে ১৭.৮২ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিভিন্ন পণ্য আমদানি করলেও রফতানি এক বিলিয়ন ডলারেরও কম। বিশাল এই বাণিজ্যঘাটতি কমিয়ে আনা, বাংলাদেশে অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে চীনের বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শিল্প স্থাপন, সাত বিলিয়ন ডলারের ঋণসহায়তা ও দ্বিপক্ষীয় কৌশলগত সম্পর্ক উন্নয়নে এখন চীন সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চীনে আজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যবসা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সামিট। আগামীকাল দু’দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য বৈঠক এবং ২০টির মতো সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষরিত হবে। অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিডিপি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, এই সফরে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে যদি প্রত্যাশিত (সাত বিলিয়ন ডলার) ঋণ সহযোগিতা পায় তাহলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর ক্ষেত্রে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে চীনের ঋণ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। যতটা জানতে পেরেছি পাঁচ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে চীন সফর করেছেন। আর চীনের প্রেসিডেন্ট শিন জিনপিং ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সফরে আসেন।
আয়োজকরা জানান, আগামীকাল বুধবার বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপলে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক হবে। সেখানে তাদের সাথে দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলও থাকবে। ওই সময়ে সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে।
জানা গেছে, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ঋণের সন্ধান বা উন্নয়ন সহযোগীদের খুঁজছে। এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ঋণ বা বিনিয়োগ অনেক ভালো একটা খাত। চীন বিভিন্ন দেশে ঋণ প্রদান করছে। কারণ তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ উদ্বৃত্ত রয়েছে। আঞ্চলিক বিবেচনায় বাংলাদেশ চীনের বড় একটা রফতানির উৎস। বাংলাদেশে তারা বছরে ২৩ বিলিয়ন ডলার রফতানি করে। আর বাংলাদেশ রফতানি করে এক বিনিয়োগ ডলারের কম।
প্রধানমন্ত্রীর এই সফর প্রসঙ্গে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চীনের সাথে আমাদের কৌশলগত সম্পর্ক আছে। সফরে কৌশলগত সম্পর্ক আরো গভীর হবে। তিনি বলেন, চীন প্রযুক্তিগতভাবে অনেক এগিয়ে। আমরা যদি দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে প্রযুক্তিগত সুবিধা নিতে পারি তাহলে আমাদের কৃষি, শিল্পের অগ্রগতি ও সম্প্রসারণে আরো এগিয়ে যেতে পারব। তিনি বলেন, চীন বাংলাদেশে বছরে ২৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে। অথচ বাংলাদেশ থেকে তারা এক বিলিয়ন ডলারেরও কম আমদানি করে। ফলে বড় ধরনের একটা বাণিজ্যঘাটতি এই সফরে দ্বিপক্ষীয় কৌশলগত আলোচনার মাধ্যমে কিছুটা হলেও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ঋণ ও বিনিয়োগ আনতে পারলে আমাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে অনেক বড় ধরনের সহায়ক হবে। তিনি বলেন, চীন যেসব শিল্পে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বজায় রাখতে পারছে না, সেগুলোকে যদি বাংলাদেশে নিয়ে আসা যায় তাহলে এ দেশে বিনিয়োগ বাড়বে। তাদের এই শিল্পগুলোকে আমাদের দেশে স্থাপন করা গেলে আমাদের রফতানিও বাড়বে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর চীনের এই সফর আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ সফর। তারা আমাদের বড় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সহযোগী। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশ। দ্বিপক্ষীয় কৌশলগত আলোচনার মাধ্যমে আমরা তাদের কাছ থেকে অনেক সুবিধা আনতে পারব।
ড. মোস্তাফিজ বলেন, আমরা আগামীতে এলডিসি থেকে বের হয়ে যাচ্ছি। চীন আমাদের ৯০টির বেশি পণ্যে শর্তযুক্ত সুবিধা দিচ্ছে। এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে আমরা সেই সুবিধা পাবো না। এলডিসি উত্তরণের পরবর্তী সময়ে আমাদের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তিনি বলেন, ২০১৪ সালে সামুয়া এলসিডি থেকে বের হয়ে যায়। তখন চীন তাদেরকে বেশ কয়েক বছর শর্তযুক্ত সুবিধা দিয়েছে। আমরাও যদি সেই সুবিধা এবারের সফরের দ্বিপক্ষীয় আলোচনা থেকে চূড়ান্ত করতে পারি তাহলে আমাদের জন্য ভালো হবে। এ দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বাংলাদেশ-চীন দ্বিপক্ষীয় এই সম্পর্ক ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক চীন সফরের মধ্যদিয়ে সূচনা হয়। অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বাংলাদেশ থেকে পণ্য রফতানি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, আরো দুটো চায়না-বাংলাদেশে ফ্রেন্ডশিপ সেতু নির্মাণসহ ২০টির মতো সমঝোতাস্মারক চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে।
সম্প্রতি সংসদের বাজেট অধিবেশনে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম জানান, ২১০টি দেশের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য লেনদেন থাকলেও ৮২টি দেশের সাথে বাণিজ্যঘাটতি রয়েছে। চীনের সাথে বাণিজ্যঘাটতি সবচেয়ে বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যঘাটতি এক হাজার ৫২৩ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। যেখানে চীনের সাথে এক হাজার কোটি ডলারের বেশি।
তৈরী পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, চীন ১৪০ কোটি জনসংখ্যার একটি বিশাল সম্ভাবনাময় বাজার। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে এ দেশের জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সাথে উৎপাদন ব্যয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীনের বাজারে ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা পেলে তৈরী পোশাকসহ বাংলাদেশের রফতানি সক্ষমতাসম্পন্ন প্রায় সব চীনে শুল্কমুক্ত কোটামুক্তভাবে প্রবেশের সুবিধা পাবে। ফলে চীনে রফতানি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়, যা বাংলাদেশের বাণিজ্যবৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও খুলনা-৪ আসনের এমপি আবদুস সালাম মুর্শেদী এই সফর প্রসঙ্গে নয়া দিগন্তকে বলেন, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে চীন আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের এখানে বিভিন্ন খাতে তাদের বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রীর এই চীন সফর সঠিক সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, আমরা এক শ’টি অর্থনৈতিক জোনের অনেকগুলোই সম্পন্ন করেছি। এখানে তারা বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ঘুরেও গেছে। ফলে প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে তাদের বিনিয়োগ দ্রুত পাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে। তিনি বলেন, আমাদের বেশির ভাগ আমদানি চায়না থেকে আসে। তারা শিল্প খাতে বড় বড় মেশিনারিজ তৈরি করছে। শিল্পগুলোকে যদি আমরা বাংলাদেশের ইপিজেডে আনতে পারি আমাদের জন্য অনেক ভালো হবে। তিনি বলেন, চীনের সাথে কারেন্সি টু কারেন্সি লেনদেন হলে রফতানি দ্বিগুণ হবে। আমরা এই বিষয়ে ভারতের সাথেও আলোচনা করছি। মংলা বন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের করতে পারলে আমাদের রফতানি বাড়বে। এই বন্দর ও সুন্দরবন উন্নয়নে তাদের সহযোগিতা দরকার। পাশাপাশি খান জাহানআলী বিমানবন্দরের উন্নয়নে চীনের বিনিয়োগ আনার ব্যাপারে আলোচনা করা হয়।
এই সফর নিয়ে সম্প্রতি ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, তিস্তা বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের যৌথ নদী। তিস্তা নদীর যৌথ ব্যবস্থাপনার বিষয়ে ভারত একটি প্রস্তাব দিয়েছে। তারা একটি কারিগরি দল পাঠাবে বলে আমাদের জানিয়েছে। বাংলাদেশে এসে ওই কারিগরি দল যৌথভাবে সমীক্ষা করে কী করা উচিত, সে ব্যাপারে পরামর্শ দেবে। যেহেতু দুই দেশের যৌথ নদী এবং যাদের সাথে যৌথ নদী, তাদের প্রস্তাব আছে, সুতরাং আমাদের সেই প্রস্তাব বিবেচনা করতে হবে। চীনও এ ক্ষেত্রে প্রস্তাব দিয়েছে, সেটি ভালো। যেহেতু ভারত প্রস্তাব দিয়েছে, আমরা মনে করি সেটি ভালো দিক। তারা (চীন) যদি আলোচনায় আসে, তাহলে তো আলোচনা হবে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়্যাত উল ইসলাম এই বিনিয়োগ সামিট প্রসঙ্গে দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে অতীতে আমরা যেসব রোড করেছি এবারে আমরা তার চেয়েও বেশি সাড়া পাচ্ছি তাদের কাছ থেকে। এই আয়োজন নিয়ে এখানে বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখতে পাচ্ছি। আশা করছি, চীনের সাথে আমাদের বন্ধুত্বের যে সম্পর্ক আছে সেটি আরো মজবুত হবে। সম্পর্কের আরো একটা নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।