বাজারের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে?

নিবার সকাল সাড়ে ১১টায় তালতলা কাঁচা বাজার। বাজারে ক্রেতারা দরদাম করে পণ্য কিনছিলেন। তাদেরই একজন মরিয়ম খাতুন। জিনিসপত্রের দাম নিয়ে কথা বলতে গেলেই একরাশ হতাশা প্রকাশ করলেন তিনি। বললেন, সব ধরনের জিনিসের দাম অত্যধিক। কাঁচা মরিচের কেজি ৩২০ টাকা। ৩০ টাকার সবজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। আলুর কেজি ৬৫ টাকা। এ ছাড়া চাল, পিয়াজ ও রসুনের দামও বেড়েছে। বাজার করতে এসে হিসাব মেলাতে পারছি না।
কোরবানির ঈদের পর থেকে প্রতিদিনই কোনো না কোনো জিনিসের দাম বেড়েছে। এই বাজারের আরেক ক্রেতা ব্যবসায়ী আতাউর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, জিনিসের দাম ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বৃষ্টির অজুহাতে সব ধরনের সবজির দাম অনেক বেড়েছে। মাছ ও মাংসের কাছে তো যাওয়ার উপায় নেই। ডিমের দামও বেড়ে ১৬০ টাকা হয়েছে। দুই সপ্তাহ আগেও কাঁচা মরিচের কেজি ১৫০ টাকা ছিল, তা এখন বেড়ে ৩২০ টাকা হয়েছে। মাছের দামও অনেক বেড়েছে।
নিত্যপণ্যের বাড়তি দামে ত্রাহি অবস্থা ক্রেতাদের। বাজারে গিয়ে হিসাব মেলাতে পারছেন না ক্রেতারা। বাজার পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, কোনো পণ্যের দাম স্থির হলে বেড়ে যাচ্ছে অন্য একটার। এ কারণে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আসলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কারা। বা আদৌ নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কাজ করছে কিনা?

সবজিতে স্বস্তি নেই: কাঁচা বাজারগুলো ঘুরে দেখা যায়, আড়তভরা সবজি। তারপরও বৃষ্টির কারণ দেখিয়ে প্রায় প্রতিটি সবজির দাম কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। খুচরা বিক্রেতারা জানান, কাঁচা মরিচ ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা, টমেটো ২০০ টাকা, গাঁজর ১০০ টাকা, বেগুন ৮০ থেকে ১২০ টাকা, পটোল, ঝিঙে, ধুন্দুল ৬০ টাকা, করলা ৭০ থেকে ৮০ টাকা, শসা ৮০ থেকে ১০০ টাকা, ঢ্যাঁড়স ৫০ থেকে ৬০ টাকা, লাউ ও চালকুমড়ার পিস ৭০ থেকে ৯০ টাকা। কচুরলতির কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা, বরবটি ১০০ টাকা কেজি।

রসুনের কেজি ২৪০, পিয়াজের ১২০ টাকা: সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে পিয়াজের দাম। রাজধানীর বাজারগুলোতে এখন ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি পিয়াজ। শনিবার তালতলা ও বিএনপি বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়। বিএনপি বাজারে পিয়াজ ও রসুন কিনতে আসেন শিক্ষার্থী জুনায়েদ। তিনি বলেন, এক মাস আগেও পিয়াজ কিনেছি কেজি ৯০ টাকায়। এখন সেই পিয়াজের দাম ১২০ টাকা। আর এক মাসের ব্যবধানে ৫০ থেকে ৬০ টাকা বেড়ে রসুনের দাম হয়েছে ২৪০ টাকা। আধা কেজি পিয়াজ কেনার পরিকল্পনা থাকলেও ২৫০ গ্রাম পিয়াজ কিনতে হচ্ছে বলে জানান এই শিক্ষার্থী। এদিকে পিয়াজের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা জানান, দেশি পিয়াজের সাপ্লাই কমে যাওয়ায় দাম বাড়ছে। এখন ভারতীয় পিয়াজ বিক্রি করতে হচ্ছে। আপাতত কমার কোনো সম্ভাবনা নেই।

আলুর কেজি ৬০ থেকে ৬৫ টাকা: সুখবর নেই আলুতেও। শনিবার বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। ফলে সপ্তাহের ব্যবধানে পণ্যটির দাম ৫ টাকা বেড়েছে। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)’র তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে আলুর দাম ৫৫.১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছরের এই সময়ে প্রতি কেজি আলুর দাম ছিল ৩৮ থেকে ৪০ টাকায়।

চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী: সম্প্রতি বোরো ধান উঠেছে। তারপরও কমছে না চালের দাম; বরং বর্ষার অজুহাতে সপ্তাহের ব্যবধানে আটাশ ও মোটা চালের খুচরা বাজারে কেজিতে ১ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে। তবে আগের মতোই মিনিকেট চালের দাম ৭০ থেকে ৭২ টাকা। খুচরা বিক্রেতা নাসির হোসেন জানান, আগের সপ্তাহে আটাশ চাল ৫২ থেকে ৫৫ টাকা বিক্রি হলেও এখন তা ৫৮ টাকা ও ৫০ থেকে ৫২ টাকার মোটা চাল ৫৫ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ঈদের পরে আটাশ চাল ও মোটা চালের দাম কিছুটা বেড়েছে।

হাত দেয়া যাচ্ছে না কাঁচা মরিচে, কেজি ৩২০ টাকা: কাঁচা মরিচের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। সপ্তাহ’র ব্যবধানে কেজিতে ১০০ থেকে ১২০ টাকা বেড়ে ৩২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রকারভেদে ২৫০ গ্রাম কাঁচা মরিচ ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতারা ১০ টাকার মরিচ কিনতে চাইলে বিক্রেতা অপারগতা প্রকাশ করছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দামের কারণে ১০ টাকার মরিচ বিক্রি করা যায় না। ১০০ গ্রামের নিচে মরিচ বিক্রি করা ব্যবসার জন্য ক্ষতি। চাহিদার তুলনার বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বাড়ছে বলেও জানান তারা।

খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে: এদিকে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ৮টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে খোলা সয়াবিন তেল। বাজারে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ টাকা দরে। এর আগে চলতি বছরের ১৮ই এপ্রিল খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটারের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৪৭ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। তবে বোতলজাত সয়াবিন তেল নির্ধারিত দামেই বিক্রি করতে দেখা গেছে।

ডিমের দাম চড়া: রাজধানীতে ফার্মের বাদামি ডিম প্রতি ডজন ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর হালি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়। অথচ ডিম উৎপাদক খামারিরা পাইকারদের কাছে এসব ডিম বিক্রি করছেন ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা দরে। অর্থাৎ পাইকারি পর্যায়ে প্রতি ডজনে ২৫ টাকার বেশি দাম বাড়ছে। এমন মূল্যবৃদ্ধিকে অস্বাভাবিক দাবি করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলেছে, পাইকারি ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণেই ডিমের দাম বাড়ছে।

মাছের দামও বাড়তি: বাজারে সব ধরনের মাছের দাম বাড়তি। বাজারে প্রতি কেজি পাবদা বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়, চিংড়ি প্রতি কেজি ৭০০ টাকা, পাঙাশ মাছ প্রতি কেজি ২০০ থেকে ২২০ টাকা, তেলাপিয়া প্রতি কেজি ২৫০ টাকা, রুই প্রতি কেজি ৩৫০ টাকা, কাতল প্রতি কেজি ৪০০ টাকা, কই প্রতি কেজি ২৫০ টাকা, শিং মাছ প্রতি কেজি ৪০০ টাকা, টেংরা প্রতি কেজি ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা, বড় বোয়াল প্রতি কেজি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, বড় আইড় মাছ প্রতি কেজি ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বাজার বিশ্লেষকরা যা বলছেন: নিত্যপণ্যের লাগামছাড়া দাম বৃদ্ধি নিয়ে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের পকেট কাটার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো যেহেতু সেভাবে তদারকি করতে পারছে না, সেহেতু তারা নিজের ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছে। এ বিষয়ে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন মানবজমিনকে বলেন, এখন ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা চলে যে, কে কতো টাকা নিতে পারে। একটা সময় কয়েকটি পণ্যের সংকট হতো, এখন সবগুলো পণ্যেরই সংকট দেখা যায়। এর মূল কারণ হলো কে কতো মুনাফা করতে পারে, কে কতো পকেট কাটতে পারে। তিনি বলেন, সরকারের তদারকির পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক কমেছে। এখন ব্যবসায়ীরাই সর্বেসর্বা। তারা যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই ব্যবসা করতে পারছেন। এগুলো আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক। বর্তমানে সীমিত আয়ের মানুষদের জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।